হাসান তানভীর এর MOTO-TRAVEL ব্লগ

Its better to travel well, then to arrive – Buddha

সোনাদিয়া দ্বীপ (Sonadia Island)

DSC03922

সোনাদিয়া দ্বীপ যেন ক্যানভাসে আঁকা। এই সাগরকন্যা আমাকে যেন মাতাল করে ফেলেছিলো। আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই টুর টা। এত ভালো লেগেছে বলার মত না।

১৭ জানুয়ারি/ শুক্রবার

আগের রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। সকাল ৮ টায় রওনা দিলাম মোটরবাইক নিয়ে। মন উড়ু উড়ু। আবার হারিয়ে যাওয়া অনেক দুরে। এবার গন্তব্য সোনাদিয়া দ্বীপ। এই দ্বিপের কিছু গল্প শুনে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। সেন্ট মার্টিন এর চেয়েও নাকি সুন্দর।

প্রথমে চলে গেলাম কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলাতে। চকরিয়া থেকে ডানে টার্ন নিয়ে বগার খালি হয়ে ল-ম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়ে গোরকঘাটা, মহেশখালি।

DSC03841

প্রথমে “মহেশখালী জেটি” তে গেলাম। দারুন। অনেক লম্বা ব্রিজ।

DSC03865

আর দুপাশে জলাভুমি আর পেরাবন। প্রচুর অথিতি পাখি আছে।

DSC03848

গিয়ে শুনলাম এখান থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ যাওয়া যাবে না। ঘটিভাঙ্গা হয়ে যেতে হবে। ঠিক আছে। ওকে বাবা ওকে। নো প্রব্লেমো। যেহেতু থাকতেই হবে আজ, চলুক ঘোরাঘুরি।  ফিরে এসে প্রথমে গেলাম বিখ্যাত আদিনাথ মন্দির।

DSC03853

এর পর পাশেই মৈনাক পর্বত এ ট্র্যাকিং করলাম দেড় ঘন্টা। দারুন সব ভিউ।

DSC03862

DSC03854

প্রবেশ পথে দারুন সব উপজাতি সুন্দরী মেয়েরা বাহারি পন্যর পসরা নিয়ে বসেছে।

DSC03852

সুন্দরী রা ক্যামেরা দেখে সরে যায় – ইনি ই আছেন।

ট্র্যাকিং সেরে হোটেল নিলাম। গ্রিন পেলেস। বাজার হোটেল এর চেয়ে ভালো। মাত্র ২০০ টাকা। রাতে বাজার থেকে গিয়ে খেয়ে এসেছিলাম।

১৮ জানুয়ারি/ শনিবার

পরদিন সকাল ৭ টায় হিম হিম কুয়াশার মাঝে রওনা দিলাম ঘটিভাঙ্গা।

DSC03870

DSC03871

৪০ কিমি হবে। দারুন পথ। মাঝে মাঝে গ্রাম। আর কেওয়া বন।

DSC03945

আসার পথে – তখন কুয়াশা ছিলো না। কি দারুন রোড

যেটা একমাত্র দেখেছিলাম সেন্ট মার্টিন এ। এগুলার দেখা পেয়েছিলাম উপকূলীয় অঞ্চল বলে। সাড়ে নটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম। ওখানে একটি দোকানে কথা বলে বাইক রাখার বেবস্থা করলাম। পরে দেখি নৌকা বা হেটে – ২ ভাবেই যাওয়া যায়। আমার আবার হেটে বেড়ানোর শখ বেশী। এর কারন হলো, নানা অজানা কিছু দেখা/জানা যায়। অবশ্য জোয়ারের পানি তখনো আসেনি বলে ট্রলার ছাড়বে না। আর ছোট নৌকা বেশ ভাড়া চায়। দারুন একটা পথ। দুপাশেই ম্যান গ্রোভ এর বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্রায় ২০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে।

DSC03873

DSC03878

DSC03876

DSC03875

এক পাশে লেক। আর অনেক অথিতি পাখি। প্রায় দেড় ঘন্টা হেটে পৌঁছে গেলাম সোনাদিয়া দ্বীপ এর পূর্ব পাড়।

DSC03884

অপরূপ সৌন্দর্যের আধার এ দ্বীপ ককসবাজার শহর থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমের দূরে সাগর গর্ভে অবস্থিত। দ্বিপের আয়তন লম্বায় ৭ কিমি, প্রস্থ আড়াই কিমি। ২ ভাগে বিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিম। দ্বিপে কোন হোটেল নেই। তবে গিয়াস ভাই নামে একজন – তার কাছে থাকার/খাওয়ার বেবস্থা আছে (ওনার ফোনঃ ০১৮১২২২৪৪১২) এমনকি চাইলে রাতে থাকতে পারবেন কেম্পিং করে। তাবু আছে গিয়াস ভাই এর কাছে।

সাগরের ৩ টা চ্যানেল এ ২ টা ব্রিজ আর একটা বাশের সাকো দিয়ে এই বিচ্ছিন্ন  দ্বীপ এর সাথে সংযোগ দেয়া হয়েছে।   এই দ্বিপের তিন দিকে সমুদ্র সৈকত,সাগর লতা পাতা ঢাকা বালুতীর, কেয়া- নিশিন্দার ঝোপ, ছোট-বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন। আরো আছে বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখি।

এই দ্বিপে অজস্র লাল কাঁকড়ার ছড়াছড়ি। আর কচ্ছপ এসে ডিম পাড়ে সাগর কিনারে। আছে গাংচিলের ভেসে বেড়ানো। নীল আর স্বচ্ছ পানি আয়নার মত।  এক পাশে জুড়ে আছে কেওয়া বনের সারি।

অবশেষে সাগরের কিনার পৌঁছে নীল পানি দেখে পাগল হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ থেকে রওনা দিলাম পশ্চিম পাড়ে তীর ধরে।

DSC03883

ভীষণ ভালো লাগছিলো সাগরের শীতল হাওয়া আর খালি পায়ে হেটে যাওয়া। গাংচিলের অলস ভাবে উড়ে বেড়ানো।

হাটার নিয়ম হলো একদম সাগরের কাছে তীর দিয়ে হাটতে হবে। নাহলে বালি তে পা ডুবে যায়। এই পুরা দ্বীপ জুড়ে বালি। এমন কি দ্বিপের ২ হাজার মানুষের বসতি যেখানে, সেখানেও বালি আর কেওয়া বন।

হাটতে শুরু করতেই দেখা পেলাম কাঙ্খিত লাল কাঁকড়া। এরা এত টক টকে লাল হয় বলার মত না। প্রথমে অনেক্ষন এদের ছবি তুলতে পারছিলাম না। কারন এরা দুর থেকেই পালিয়ে যায়। হয়তো টুক টুক করে ৪ পায়ে কার্টুন এর মত দৌড় দিয়ে সাগরে লাফ দিয়ে পড়ে অথবা টুক করে কোন গর্তে ঢুকে পড়ে।

DSC03914

অবশেষে সাফল্য। অনেক চেস্টা করে আমি একটা লাল কাঁকড়া (Red crab) ধরে ফেললাম। অনেক মজা করলাম এই কাঁকড়া দের সাথে। এদের কে হতম্ভব করে দিলে এরা তখন না পালিয়ে আপনার দিকে তার অস্ত্র (তার দাড়) উঁচু করে নিয়ে তাকিয়ে তাখবে।

DSC03902

আর মাঝে মাঝে ডানে বামে ডান্সিং করবে। অনেক হেসেছি এদের কান্ড কারখানা দেখে।

DSC03900

Red crab at sonadia island

DSC03895

আমার শিকার

এই সব করতে করতে এক সময় পৌঁছে গেলাম পশ্চিম পাড়ে।  😀 ঘন্টা দেড়েক লাগলো।

ওখানে পৌঁছে জাপিয়ে পড়লাম নীল পানিতে। দাপাদাপি শেষ করে খুঁজে পেলাম গিয়াস ভাই কে। উনি কচ্ছপের জন্য ঘর বানাতে বেস্ত।

DSC03926

sea-turtle-nest

কচ্ছপের ডিম

DSC03906

এই পাখিটি তীরে পড়ে ছিলো…

কিছুক্ষণ পর নিয়ে গেলেন বাসায়। গরম ধোয়া ওঠা ভাত, লাউ দিয়ে চিংড়ি খেতে খেতে মনে হল অমৃত খাচ্ছি। আজ ফেরার কোন নৌকা ছিলো না। ১২ টায় চলে গেছে একটা। কি করা যায়। পরে তিনি এক জনের সাথে কথা বলে ছোট একটা ট্রলার বেবস্থা করলেন – ৫০০ টাকা। চড়ে বসলাম।

DSC03933

 

DSC03943

টিকাঃ ১) আপনি গেলে, অবশ্যই রাতে কচ্ছপের ডিম পাড়ার সময় আলো জালবেন না। ২) আপনি কক্স বাজার এর কস্তুরি ঘাট (৬ নং) থেকেও যেতে পারেন। তবে আমি যেভাবে গিয়েছি, অনেক কাছে।

সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার অর্ন্তগত হোয়ানক ইউনিয়নে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এটি জীববৈচিত্রের দ্বীপ নামেও পরিচিতি এবং এ দ্বীপ প্রাকৃতিক সুন্দর্য পিপাসুদের জন্য অন্যতম পর্যটন স্থান।[১] চারদিকে গভীর সমুদ্রের সাগরের ঢেউ সমৃদ্ধ এটি মুলত প্যারাদ্বীপ নামে পরিচিতি।

যাই হোক,  ফিরে এলাম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল আর অতিথি পাখি দেখতে দেখতে। ঘটিভাঙ্গা থেকে বাইক নিয়ে ফিরেছি চকরিয়া যাবার অন্য একটা রোড দিয়ে। দারুন।  দীনেশপুর উপকূলীয় বনের ভেতর দিয়ে।

DSC03950

চকরিয়া পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলো চালিয়ে চলে গেলাম বান্দরবন এর উপজেলাম আলী কদম এর মিরিঞ্জা তে।

এখানের রোড গুলো এত সুন্দর – ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ঠিক ছবির মত।

DSC03958

মিরিঞ্জা থেকে চার পাশের ভিউ দেখে যে কারো কবি হবার উপক্রম হবে। এত দারুন। তবে ঠিক সূর্য বিপরীত দিকে থাকায় ছবি তুলতে পারিনি 😦

DSC03960

in the ship of Mirinja (go top)

ছবি তোলা শেষ করে কিছুক্ষণ বাইক চালালাম ইচ্ছেমত রোলার কোস্টার এর মত পথ গুলো তে। আলী কদম সম্পর্কে জানতে আমার আরো একটি লিখা আছে, বিস্তারিত এখান থেকে পড়ে নিতে পারেন।

সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইক চালালাম সাধ মিটিয়ে। এর পর রওনা দিলাম কক্স বাজার। রাতে এখানে থাকলাম। বার্মিজ মার্কেট থেকে এটা সেটা কিনলাম।

আমি কোথাও রাতে থাকলে যেটা করি, হোটেল ঠিক করে একটু রেস্ট নেই। তার পর পুরা শহর ঘুরে বেড়াই। চা দোকানে কথা বলি। মার্কেট এ যাই ইত্যাদি। রাতে বিচ এ গেলাম। এখানের কথা আর বলার কিছু নেই। আপনি ভাল করেই জানেন। অনেক বার ই তো গেছেন

১৯ জানুয়ারি ২০১৩/ রবিবার

সকাল ১০ টায় রওনা দিলাম। প্রথমে লোগাগড়ার আমিরাবাদ থেকে কেয়াজুপাড়া ফেলে চলে গেলাম কোয়ান্টাম। প্রায় ১০০ কিমি পথ।

DSC03966

কোয়ান্টাম এর কাছেই এই লেক

এখানে এদের প্রকৃতির নীরবতা আর অতুলনীয় সৌন্দর্যের মাঝে ধ্যান করার বেবস্থা আছে। আর আছে কোয়ান্টাম শিশু কানন। এখানে আদিবাসি বাচ্চারা বিনামুল্য থাকে, পড়ে।

DSC_0062

DSC_0061

আনারস বাগান

এরপর ৪ কিমি দুরে কেয়াজু পাড়া থেকে রওনা দিলাম লামা’র উদ্দেশ্য। ওখান থেকে আলী কদম হয়ে চকরিয়া দিয়ে বের হব। ৪৫ কিমি পাহাড়ি পথ। ২৫ কিমি পরেই লামা।  পথের ২ পাশে সারি সারি গাছপালা। আর প্রচুর আদিবাসি দের করা তামাক খেত। লামা থেকে আলী কদম হয়ে চকরিয়া দিয়ে বের হলাম।

DSC03968

DSC03971

তামাক খেত

DSC_0053

এরপর সোজা Home sweet home. একটান দিয়ে চলে এলাম ঠিক সন্ধার আগে।

সাধ মিটিয়ে ঘুরতে পেরেছি স্বল্প !!! সময়ের ভেতর। বাইক ও চালিয়েছি ইচ্ছে মতন। সব মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ তাআলার মেহের বানিতে কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই সুস্থ ভাবে পৌছাতে পেরেছি।

যাত্রী

জীবনানন্দ দাশ

মনে হয় প্রাণ এক দূর স্বচ্ছ সাগরের কূলে
জন্ম নিয়েছিলো কবে;
পিছে মৃত্যুহীন জন্মহীন চিহ্নহীন
কুয়াশার যে ইঙ্গিত ছিলো —
সেই সব ধীরে ধীরে ভুলে গিয়ে অন্য এক মানে
পেয়েছিলো এখানে ভূমিষ্ঠ হয়ে — আলো জল আকাশের টানে;
কেন যেন কাকে ভালোবেসে!

(অংশ বিশেষ)

4 comments on “সোনাদিয়া দ্বীপ (Sonadia Island)

  1. Jahid Shuvo
    January 19, 2014

    আপনার ভ্রমন কাহিনীগুলো আসলেই চমৎকার। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন আমি নিজেই চলে এসেছি। ধন্যবাদ শেয়ার করবার জন্য।

    Like

    • Hassan Tanvir
      January 19, 2014

      ভালো লাগলো জেনে। আপনাকেও ধন্যবাদ।

      Like

  2. Aticul islam
    February 8, 2014

    Hassan Tanvir ভাই আপনার সাথে করে কি সব সময় ১টা বাইক নিয়ে যান? দেশে বা ‍বিদেশে সব সময় দেখলাম ১টা বাইক সাথেই আছে। আসল ব্যপারটা কি বলেন তে।

    Like

    • Hassan Tanvir
      February 8, 2014

      ব্যাপারটা হচ্ছে I love bike 🙂

      Like

Leave a comment

Join 248 other subscribers

Contact Info

Email: black_guiter@hotmail.com Skype: hassan.tanvir1
copyright @ hassantanvir.wordpress.com 2015